কক্সবাজারে ট্রলারে ১০ লাশ, এখন পর্যন্ত যা জানা গেলো

আবদুল আজিজ, বাংলা ট্রিবিউন •

কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে ট্রলার থেকে ১০ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় অনেকগুলো ক্লু পেয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে সাগরে মাছ ধরা নিয়ে মাঝিদের দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তার, মাছ ধরার আড়ালে মাদকের চোরা চালান নিয়ে বিরোধ, জেলে ও ডাকাতদের মধ্যে বিরোধের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। সবগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম।

তবে ঘটনাটি রহস্যে ঘেরা উল্লেখ করে পুলিশ বলছে, মামলার এজাহারভুক্ত ১ নম্বর আসামি কামাল প্রকাশ ওরফে বাইট্টা কামাল এবং ৪ নম্বর আসামি করিম শিকদার ঘটনার বিষয়ে রিমান্ডে অনেক তথ্য দিয়েছেন। ফলে রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। ঘটনায় জড়িত অনেকের নাম আসছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। ইতোমধ্যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেন, কী কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে, ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কয়েকজনকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে এখন মূল ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে।

যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ

নিহতদের মধ্যে জেলে নয়, এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। এর মধ্যে একজন শাপলাপুর ইউনিয়নের মিটাছড়ি গ্রামের মুসা আলীর ছেলে ওসমান গনি (১৭)। ট্রলার মালিক সামশুল আলম সাধারণত মাছ ধরতে যান না। সেদিন কেন তারা সাগরে মাছ ধরতে গেলেন, আদৌ গেছেন কিনা? নাকি অন্য স্থানে তাদের হত্যা করা হয়েছে। ট্রলারে কতজন ছিল? বাকিরা কোথায়? কেউ বেঁচে আছে কিনা। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ। পাশাপাশি মঙ্গলবার রাতে সোনাদিয়া চ্যানেলের প্যারাবন থেকে আরও একজনের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। কঙ্কালটি ওই ট্রলারে থাকা নিখোঁজ জেলের বলে ধারণা পুলিশের।

নিহত দুই জনের বিরুদ্ধে আছে মাদক ও হত্যা মামলা

পুলিশ বলছে, নিহত ট্রলার মালিক সামশুল আলম ও নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় মামলা রয়েছে। নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ডাকাতির মামলা আছে দুটি। সামশুল আলমের বিরুদ্ধে মাদক ও হত্যা মামলা রয়েছে দুটি।

এখন পর্যন্ত তদন্তে কী কী জানা গেলো জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘কে অপরাধী, কে নিরপরাধ, তা দেখার জন্য আইন আছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। অনেকগুলো ক্লু পেয়েছি। তদন্তের স্বার্থে সেগুলো বলছি না। পুলিশ, পিবিআই ও সিআইডি তদন্ত করছে। দ্রুত ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে পারবো।’

বুধবার সদর হাসপাতালে ১০ লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘কারও শরীরে গুলি কিংবা অন্য কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের হাত-পা বেঁধে ট্রলারের কুটিরে (মাছ ও বরফ সংরক্ষণের কক্ষ) আটকে রেখে হত্যার বিষয়টি পরিষ্কার। রিমান্ডে মামলার এজাহারভুক্ত ১ নম্বর আসামি কামাল ও ৪ নম্বর আসামি করিম শিকদার অনেক তথ্য দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। এর সূত্র ধরে চলছে তদন্ত। ঘটনায় যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কামাল ও করিম রিমান্ডে আছেন।’

আধিপত্য বিস্তার ও মাঝিদের মধ্যে বিরোধ

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একসঙ্গে ১০ জনকে হত্যার ঘটনাটি নির্মম। তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি আমরা। সাগরে মাছ ধরা নিয়ে আধিপত্য বিস্তার, মাদকের চালান নিয়ে সংঘর্ষ, জেলে-ডাকাতের মধ্যে বিরোধের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। শিগগিরই ঘটনার রহস্য জানা যাবে।’

কে এই সামশুল আলম?

সামশুল আলম ওরফে সামশু মাঝি মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়ার রফিক উদ্দিনের ছেলে। ওই ট্রলারের মালিক এবং নিহতদের মধ্যে একজন। তারা দুই ভাই, চার বোন। বাবা মৃত, মা জীবিত। সংসারে স্ত্রী ও এক মেয়ে ও দুই ছেলে আছে। ট্রলার ভাড়া দিলেও সাগরে মাছ ধরতে যান না। ওই দিন কেন সাগরে মাছ ধরতে গেলেন সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই স্ত্রী রোকেয়া বেগমের। তিনি বলেন, ‘কারা হত্যা করেছে, বিষয়টি আমি জানি না। তার সঙ্গে অনেকের বিরোধ আছে।’

কেন ওসমান গনির লাশ আনতে যাননি বাবা মুসা আলী?

১০ লাশের মধ্যে একটি ওসমান গনির। শাপলাপুর ইউনিয়নের মিটাছড়ি গ্রামের মুসা আলীর ছেলে তিনি। জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে ওসমান গনির লাশ শনাক্তের পরও আনতে যাননি বাবা মুসা আলী।

কেন ছেলের লাশ আনতে যাননি এমন প্রশ্নের জবাবে মুসা আলী বলেন, ‘এলাকার লোকজন বলছে, আমার ছেলে নাকি জলদস্যু, ডাকাতি করতে যাওয়ায় খুন হয়েছে। এসব কথা শোনার পর লজ্জায় ছেলের লাশ আনতে যাইনি। তার মাকে পাঠিয়েছিলাম। পরে নিজ গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করেছি।’

আমার ছেলে জেলে নয়, কোনোদিন সাগরে যায়নি উল্লেখ করে মুসা আলী বলেন, ‘মাছ ধরার কোনও অভিজ্ঞতা নেই ছেলের। ট্রলারে লাশ পাওয়া প্রতিবেশী নুরুল কবির ফুসলিয়ে ছেলেকে সেদিন নিয়ে গেছে। পরে জলদস্যুর অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’

যা বলছেন স্থানীয় জেলেরা

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাজিরারটেক এলাকার কয়েকজন জেলে জানিয়েছেন, ঘটনার পেছনে রয়েছেন কামাল প্রকাশ ওরফে বাইট্টা কামাল এবং করিম শিকদার। তারা ইয়াবা কারবারে জড়িত। গত ৯ এপ্রিল রাতে কুতুবদিয়া চ্যানেলে জাল ফেলেছিলেন স্থানীয় জেলেরা। এ সময় হঠাৎ করিম শিকদার এসে জানান, বাইট্টা কামালের ট্রলারকে ধাওয়া করেছে ডাকাতদল। মূলত ওই ট্রলারটি ছিল সামশুল আলমের। পরদিন সকালে জেলেরা খবর পান সামশুল আলমদের ‘ডাকাত’ বলে চালিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে থাকা জেলেদের হত্যা করে ট্রলারটি ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

গত রবিবার সকালে রশি দিয়ে ওই ট্রলারটি টেনে বাঁকখালী নদীর মোহনা সংলগ্ন নাজিরারটেক পয়েন্টে নিয়ে আসেন স্থানীয় জেলেরা। খবর পেয়ে দুপুর ২টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রলার থেকে ১০ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। এ সময় কয়েকজনের হাত-পা বাঁধা ছিল। পরে লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ওই দিন বিকাল ও সন্ধ্যায় সদর হাসপাতালের মর্গে এসে স্বজনরা ১০ জনের লাশ শনাক্ত করেন।

এ ঘটনায় সদর মডেল থানায় মঙ্গলবার বিকালে মামলা করেন নিহত ট্রলার মালিক সামশুল আলমের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। চার জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনকে মামলার আসামি করা হয়।

এরই মধ্যে মামলার এজাহারনামীয় ১ নম্বর আসামি কামাল প্রকাশ, ৪ নম্বর আসামি করিম শিকদার, চকরিয়ার বদরখালীর গিয়াস উদ্দিন মুনির, বাঁশখালীর কুদুকখালী এলাকার ফজল কাদের মাঝি ও একই এলাকার আবু তৈয়ব মাঝিকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে কামাল প্রকাশ ও করিম শিকদার পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।